কান্তিরঞ্জন দে
===========================================================================================
যাদবপুর কালাম কলোনী তরুণ সংঘের বারোয়ারি ভারতমাতা পূজার খুব নামডাক । গত তিয়াত্তর বছর ধরে ক্লাবটি দুর্গাপুজোর পাঁচদিন খুব ধুমধাম করে মা দুর্গার বদলে সিংহবাহিনী ভারত মাতা-র পুজো করে । বহু দূর দূর থেকে লোকে প্রতিমা দেখতে আসে । সন্দীপের গড়িয়ার ফ্ল্যাট থেকে কালাম কলোনী বড়জোর পনেরো মিনিটের পথ ।
করোণার আতঙ্কে সন্দীপ গত আট মাস ধরে কোয়ারান্টাইনে ঘরবন্দি হয়ে আছে । যতই ভাইরাসের ভয় থাকুক , পুজোর এ ক'দিন বাড়ি থেকে না বেরোলে আর চলছে না । বউ আর ছেলে মিলে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার ঠাকুর দেখবার প্ল্যান করে ফেলেছে । সন্দীপ যাবে কালাম কলোনী-র ভারতমাতা দেখতে । কাগজে খবরের সঙ্গে ঠাকুরের যে ছবি বেরিয়েছে , এক কথায় অপূর্ব । ঠিক যেন অপরূপা এক মাতৃমূর্তি।
অষ্টমীর দিন সকাল এগারোটার মধ্যেই প্যাণ্ডেলে পৌঁছে গেল সন্দীপ । সকাল সকালই ভালো । ভিড় ভাড়াক্কা থাকবে না । লোকজনের ছোঁয়াছুঁয়ির ভয় থাকবে না । ফাঁকা ফাঁকায় ঠাকুর দেখে নিরিবিলিতে শান্তিতে বাড়ি ফিরে আসবে।
প্যাণ্ডেলটাও চমৎকার করেছে । ঠিক যেন সত্যিকারের এক প্রাচীন মন্দির । ভেতরে বাইরে গেরুয়া রঙ দিয়ে নানা ধরণের অলংকরণ । রাম রাবণের ছবি ছাড়াও মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে প্রচুর হনুমানের বাঁদরের ছবি আঁকা দেখা যাচ্ছে ।
বাইরেটা রোদে ঝলমলে । প্যাণ্ডেলের ভেতরে কিন্তু কোনও আলো নেই । সকাল এগারোটায় মিছিমিছি লাইট জ্বালাবেই বা কেন ? অতএব , ভেতরটায় আলো আঁধারি । এই সময় লোকজনও একদম নেই । পুরোটাই ফাঁকা । কর্মকর্তারাও হয়তো সারারাত খাটাখাটনি করে এখন যে যার বাড়িতে বিশ্রাম করছে।
নিশ্চিন্ত মনে মণ্ডপে ঢুকে সন্দীপ বেদীর দিকে এগোতে থাকে । মঞ্চ বা বেদীর দিকটা গেট থেকে বেশ অন্ধকার লাগছে । ঠাকুর দেখতে হলে বেদীর কাছে যাওয়াই ভালো । স্পষ্ট করে।দেখতে পাওয়া যাবে তাহলে ।
বেদীর একদম কাছে এসে সন্দীপ একদম স্তম্ভিত হয়ে গেল । চোখের সামনে এ কি দেখছে সে ? এ যে অবিশ্বাস্য !! অসহ্য কষ্টে সন্দীপের দু-চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইল । ভালো করে চোখ রগড়ে নিল বেশ কয়েকবার । মুখ থেকে করোণার মাস্ক খুলে নিয়ে , আরও দু পা এগিয়ে মূর্তির যতটা সম্ভব কাছে এসে দাঁড়াল সে । তার চোখের সামনে ভারত মায়ের অপরূপা মাতৃমূর্তির রঙ মাটি খসে খসে পড়ছে । ধীরে ধীরে জেগে উঠছে , একজন সুন্দরী রমণীর বিধ্বস্ত , ক্ষতবিক্ষত , লাঞ্ছিত চেহারা ।
মায়ের পরণের চওড়া লাল পাড় সাদা শাড়িটা নোংরা , ছেঁড়াখোঁড়া । পিঠের একঢাল কালো কোঁকড়ানো চুল রুক্ষ, আলু থালু । কপালে ভোরের সূর্যের মতো বড় গোল লাল সিঁদুর টিপটি ধেবড়ে গেছে । মাথার মুকুট থেকে পায়ের নূপুর , মায়ের গায়ের সমস্ত সোনার অলংকার সন্দীপের চোখের সামনে দেখতে দেখতে গায়েব হয়ে গেল। গালে হিংস্র গাঢ় নখের আঁচড় । যেন কোনও নরপশু মায়ের গাল থেকে মাংস খুবলে নিয়েছে ।
কোথায় ভারত মাতা ? চোখের সামনে লাঞ্ছিতা , ধর্ষিতা , লুঠ হতে হতে গরীব হয়ে যাওয়া , নির্যাতিতা দেশজননী-র মূর্তি দেখতে দেখতে সন্দীপ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ।
আপনার প্রাঞ্জল লেখনী আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। অন্যমনে সাহিত্য আপনাকে শারদ শুভেচ্ছা জানায়।
উত্তরমুছুন