অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০২০

মায়ের মুখ


 

কান্তিরঞ্জন  দে 

 ===========================================================================================

        যাদবপুর   কালাম কলোনী  তরুণ সংঘের বারোয়ারি  ভারতমাতা পূজার  খুব নামডাক । গত তিয়াত্তর বছর ধরে ক্লাবটি  দুর্গাপুজোর পাঁচদিন  খুব ধুমধাম করে মা দুর্গার বদলে সিংহবাহিনী ভারত মাতা-র পুজো করে । বহু দূর দূর থেকে লোকে প্রতিমা দেখতে আসে । সন্দীপের গড়িয়ার ফ্ল্যাট থেকে কালাম কলোনী বড়জোর পনেরো মিনিটের পথ ।

      করোণার আতঙ্কে সন্দীপ গত আট মাস ধরে কোয়ারান্টাইনে  ঘরবন্দি হয়ে আছে   যতই ভাইরাসের ভয় থাকুক , পুজোর     'দিন  বাড়ি থেকে না বেরোলে আর চলছে না । বউ আর ছেলে মিলে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার ঠাকুর দেখবার প্ল্যান করে ফেলেছে । সন্দীপ যাবে কালাম কলোনী-র  ভারতমাতা দেখতে । কাগজে খবরের সঙ্গে  ঠাকুরের যে ছবি বেরিয়েছে , এক কথায় অপূর্ব । ঠিক যেন অপরূপা এক মাতৃমূর্তি।

        অষ্টমীর দিন সকাল এগারোটার মধ্যেই প্যাণ্ডেলে পৌঁছে গেল সন্দীপ । সকাল সকালই ভালো । ভিড় ভাড়াক্কা থাকবে না । লোকজনের  ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়   থাকবে না । ফাঁকা ফাঁকায় ঠাকুর দেখে  নিরিবিলিতে শান্তিতে বাড়ি  ফিরে আসবে।

         প্যাণ্ডেলটাও চমৎকার করেছে । ঠিক যেন সত্যিকারের এক প্রাচীন মন্দির ভেতরে বাইরে গেরুয়া রঙ দিয়ে নানা ধরণের অলংকরণ । রাম রাবণের ছবি ছাড়াও মন্দিরের  দেওয়ালের  গায়ে প্রচুর হনুমানের বাঁদরের ছবি আঁকা দেখা যাচ্ছে

       বাইরেটা  রোদে ঝলমলে ।  প্যাণ্ডেলের  ভেতরে কিন্তু কোনও আলো নেই । সকাল এগারোটায় মিছিমিছি লাইট  জ্বালাবেই বা কেন ? অতএব , ভেতরটায় আলো আঁধারি । এই সময় লোকজনও একদম নেই । পুরোটাই ফাঁকা । কর্মকর্তারাও হয়তো সারারাত খাটাখাটনি করে এখন যে  যার বাড়িতে বিশ্রাম করছে। 

        নিশ্চিন্ত মনে মণ্ডপে ঢুকে   সন্দীপ বেদীর দিকে এগোতে থাকে ।  মঞ্চ বা বেদীর দিকটা গেট থেকে বেশ অন্ধকার  লাগছে । ঠাকুর দেখতে হলে বেদীর কাছে যাওয়াই ভালো ।  স্পষ্ট করে।দেখতে পাওয়া যাবে তাহলে ।

            বেদীর একদম কাছে এসে সন্দীপ একদম স্তম্ভিত হয়ে গেল । চোখের সামনে এ  কি দেখছে সে  ? এ যে অবিশ্বাস্য !!  অসহ্য কষ্টে সন্দীপের   দু-চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইল । ভালো করে চোখ রগড়ে নিল বেশ  কয়েকবার । মুখ থেকে করোণার মাস্ক খুলে  নিয়ে , আরও দু পা এগিয়ে  মূর্তির  যতটা সম্ভব কাছে এসে দাঁড়াল সে । তার চোখের সামনে ভারত মায়ের অপরূপা মাতৃমূর্তির রঙ মাটি খসে খসে পড়ছে । ধীরে ধীরে জেগে উঠছে , একজন সুন্দরী রমণীর  বিধ্বস্ত , ক্ষতবিক্ষত , লাঞ্ছিত চেহারা ।         

         মায়ের পরণের চওড়া লাল পাড় সাদা শাড়িটা নোংরা , ছেঁড়াখোঁড়া ।  পিঠের একঢাল কালো কোঁকড়ানো চুল রুক্ষ, আলু থালু । কপালে ভোরের সূর্যের মতো বড় গোল লাল সিঁদুর টিপটি ধেবড়ে গেছে । মাথার মুকুট থেকে পায়ের নূপুর , মায়ের গায়ের সমস্ত সোনার অলংকার সন্দীপের চোখের সামনে দেখতে দেখতে গায়েব হয়ে গেল।  গালে  হিংস্র গাঢ় নখের আঁচড় । যেন  কোনও নরপশু মায়ের গাল থেকে মাংস খুবলে নিয়েছে ।

       কোথায় ভারত মাতা  ? চোখের সামনে   লাঞ্ছিতা , ধর্ষিতা , লুঠ হতে হতে গরীব  হয়ে যাওয়া নির্যাতিতা দেশজননী-র মূর্তি দেখতে দেখতে সন্দীপ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ।

 

     

 

1 টি মন্তব্য:

  1. আপনার প্রাঞ্জল লেখনী আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। অন্যমনে সাহিত্য আপনাকে শারদ শুভেচ্ছা জানায়।

    উত্তরমুছুন