মন্দিরাঘোষ
=====================================================================================
মা,
অনেকদিন দেখিনি তোমায়।ঘুমের মধ্যেও ভুল করে আসনি একবার!
জীবনের স্তব্ধ মুহুর্ত গুলো ফিরে পাবার স্পর্ধায় সময়ের জাল ছিঁড়ে আজ তোমার সামনে আমি।
মস্ত উঠোন,গোলাভরা ধান,কাঁঠালগাছের শান্ত ছায়া সব কেমন ছুঁয়ে আছে আমার মনখারাপের বারান্দায় তোমার অস্তিত্বের টুকরো হয়ে।লালিত ফুলগাছে,কলঘরে, তোমার গন্ধমাখা বিছানায়,নকশী কাঁথার আদরে-কোথায় নেই তুমি! অথচ তোমায় ছুঁয়ে দেখার স্পর্ধা নেই আমার।
মনে পড়ে ধোঁয়াওঠা গরম ভাতের জীবন ছিল তখন।লেবুপাতায় অভাব ঢাকত তোমার দুটি হাতের ভালবাসা।
কতকগুলো ব্যাকুল চোখের সামনে তোমার লাল হয়ে যাওয়া অপ্রস্তুত মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম যেন গোলাপি মুক্তোর মত লাগত।
তোমাকে দেখতে দেখতে বেবাক ভুলে যেতাম আমাদের খিদে,দুঃখ,ব্যথা সব।
তোমার অগোছালো ভিজে শাড়ির আঁচলে আমাদের ছোট ছোট ইচ্ছে গুলো লুকিয়ে রাখতে আলগোছে তুমি।রূপকথার গল্পে ইচ্ছেগুলোকে উড়িয়ে দিতে আকাশে অদ্ভুত কায়দায়।ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো আর ফিরে আসত না।আমরাও অনায়াসে সব ভুলে মেঘবরণ কন্যার রাজ্যে পাড়ি জমাতাম।
যেন আমরাই সেই রাজ্যের রাজকন্যা রাজপুত্র!আর কোন অভাববোধ থাকত না তখন।
বেশ ছিল জীবন নিংড়ে সুখ খুঁজে আনা তেঁতুলপাতার দুয়োরানীর জীবন! কামরাঙা রঙের বিকেলে বকুল ফুলের মালা গাঁথতে গিয়ে নিজের হারিয়ে যাওয়া সুগন্ধি দিন মালার সাথে জুড়ে দিতে আর সেই গন্ধ বুকে নিয়ে তোমায় জড়িয়ে থাকতাম।হয়ত সেই সুগন্ধির ঢেউ তোমার বুকেও লাগত ভারি।
রাতের আঁধারে তোমার হাতের নকশি কাঁথার ওম টুকু ছুঁয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়লে তুমি খোলা জানলার ধারে সজল মেঘে তোমার প্রিয় তারাটিকে নামিয়ে আনতে দু চোখের মণির ভিতর একান্তে।বেদনা নিয়ে ছুঁয়ে থাকতে চাইতে অনন্ত।নোনাজলে ভিজে যেত তোমার কেঁপে ওঠা বুক।রাতের গোপন কান্নামেঘের কথা হারিয়ে যেত ভোরের আলোয়।তোমার হাসিতে,তোমার চিবুকে অন্ধকারের লুকোনো কষ্টকথা বরফকুচির মত ছুঁয়ে থাকত সবার অলক্ষ্যে।
সকাল হলেই সব ভুলে আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হতে খুব।সহজপাঠ,ধারাপাত,ঘাসফড়িঙ আর চড়াই পাখির গল্পকথায় কেটে যেত সারাটা দিন,মাস, বছর....
বর্ষার আকাশ গাঢ় হয়ে এলে তোমার কথা মনে পড়ে খুব।বৃষ্টির ভেতর সেজে ওঠে তোমার মাটির নিকোনো রান্নাঘর।ঝেঁপে আসা বৃষ্টির জলে নীল অপরাজিতার খুশিতে ডগমগ মুখ,পুঁইমাচায় আটকে থাকে তোমার হাতের যত্নগুলি। হিংসে হতো ভারি!যত সোহাগ, আদর যেন ওদের দিকেই বয়ে যেতো।
সে সব সত্যি ছিল না,শিশুমনে অভিমানের বেড়ে যাওয়া বহর,মুড়ে মুড়ে খাটো করতে বসলে ভেসে যেত সব অভিমানের আহ্লাদে।
চারদিকের নজর ছিল তোমার।খাবার সময় গরম ভাতের সুগন্ধ ঢেলে দিতে যখন আমাদের খিদের পাতে, আলসেতে বসা কাকের দল ও বাদ যেতো না।।বাবা ইস্কুল থেকে ফিরলে কাঁসার গ্লাসে এগিয়ে দিতে জল,মাটির কলসির গায়ে তোমার সংসার মাখা হাত,ক্ষয়ে যাওয়া শাঁখায় দীর্ঘ মঙ্গলকথন -আমাদের জন্মগুলি সার্থক মনে হতো।
এখন ঘামে ভেজা ফর্সা মুখ দেখলে আমি সাদা কাগজ নিয়ে আঁকতে বসি।
কাগজটি লোনাজলে ফুলে ফেঁপে তুমি হয়ে ওঠো কখন!
আজ বাতাসের আমেজ জানান দিচ্ছে শরত এসেছে।তুমি নিশ্চয় একলাটি রোদ্দুরে পুরোনো শাড়ির গন্ধ মেলে দিচ্ছো! দুপুরের ভাঁজগুলি খুলে খুলে জড়িয়ে নিচ্ছো আঙুলে,উৎকণ্ঠার অশ্রু রঙ ঝুলিয়ে আকাশের নীল বারান্দায় অপেক্ষার খাতা ভরিয়ে ফেলছো।
তোমার হাতের চমৎকার ঘনিষ্ঠতা গুলি মেলে রেখেছো বিদ্যুৎতরঙ্গে।
আরো আশ্চর্য কথা,বাবার অসুখটি সেরে গেছে কেমন তোমার নিবিষ্টতায়!
আমরা এপারে ছিপ ফেলে রেখেছি কিছু ক্রন্দনছাপ,নিষ্ফল ব্যকুলতাগুলি
তুলে নেবো বলে।
তোমার জন্য জমিয়ে রাখা যত্নগুলি খরচ করিনি একটাও!মনে রেখেছি তোমার নরম বুকের ঘ্রাণ,নিবিড় উত্তাপের মহিমাগুলি।তোমার সব বিনিদ্ররাতের আদরপালক যত্নে রেখেছি খুব।
আজ কলমে সাজানো আমার অশ্রুসাজ বিকেলের ছেঁড়া বিষণ্ণতা নিয়ে তোমার ছায়ার সামনে দাঁড়িয়ে।শুধু একটি আবদার ছড়িয়ে দিলাম বিকেলের মনখারাপে.....
আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া রাজ্যপাট নিয়ে একবার তুমি ফিরে আসবে মা!
কি যে বলি.... শুধু স্তব্ধতায় ডুবে যায় মন... স্মৃতির আঙিনায় ভেসে ওঠে কালিকাপুরের ঘরবাটির একটা জীবন্ত ছবি,যেখানে মাসিমার রাজকন্যা নিয়ে তাঁর সংসার যাপন।
উত্তরমুছুনঅনবদ্য লেখনী।
কি যে বলি.... শুধু স্তব্ধতায় ডুবে যায় মন... স্মৃতির আঙিনায় ভেসে ওঠে কালিকাপুরের ঘরবাটির একটা জীবন্ত ছবি,যেখানে মাসিমার রাজকন্যা নিয়ে তাঁর সংসার যাপন।
উত্তরমুছুনঅনবদ্য লেখনী।
আপনার প্রাঞ্জল লেখনী আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। অন্যমনে সাহিত্য আপনাকে শারদ শুভেচ্ছা জানায়।
উত্তরমুছুন