অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২১

অন্যমনে অণুগল্পে সৌরভ মুখার্জি

 


অন্যমনে অণুগল্পে সৌরভ মুখার্জি
=======================

চাদর



প্ল্যাটফর্মের এক্কেবারে শেষপ্রান্তে বুড়োটাকে একটা রংচটা বিছানার চাদর টানটান করে পেতে শুয়ে থাকতে দেখতাম রোজ। ঠিক রাধাচূড়া গাছটার নিচে। দিনের দিকে চাদরের ওপর উবু হয়ে বসে বিড়বিড় করত আর সন্ধ্যে থেকে ওই চাদরেই ঘুমোত। মাথা ভর্তি চুল, নোংরা দাড়ি। শতচ্ছিন্ন পাঞ্জাবি, তবে পাজামা নেই। বয়স ষাটও হতে পারে, নব্বইও হতে পারে। আর পাঁচটা পাগল বুড়ো ভিখিরির থেকে আলাদা কিছু না। আর ভিখিরি কবেই বা স্পেশাল হয়! কেউ দু-একটা পয়সা ছুঁড়ে দিত, কিংবা কেক-বিস্কুটের প্যাকেট একটা। কোনোদিন কেউই পাত্তা দিত না, বুড়োও কাউকে পাত্তা দিত না। নিজের চাদরে নিজের মত করে সংসার গুছিয়ে নিয়েছিল।


ওকে খেয়াল করেছিলাম ওর চাদরটার জন্যই। কোণটা একটু মুড়ে গেলে লাফিয়ে উঠে টানটান করে দিত। ব্যস্ত সময়ে অসতর্ক কোনো ডেইলি প্যাসেঞ্জারের বুটজুতো তার চাদর মাড়িয়ে দিলে রে রে করে গাল দিত। এমনকি ছুঁড়ে দেওয়া পয়সা চাদরের বাইরে পড়লে সেখানেই পড়ে থাকত, কখনো নিত না। তবে রাধাচূড়ার ফুল বা পাতা পড়লে সরাত না। চড়াই কি শালিক এসে বসলে তাড়াতো না, শুধু খ্যাক খ্যাক করে হাসত। আবার পাখিতে তার চাদরে এতটুকু নোংরা করলে বাপ-বাপান্ত করতেও ছাড়ত না। চাদরটুকুর বাইরের পৃথিবীর প্রতি যদিও কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না, কিন্তু চাদরের মধ্যের সংসারে এতটুকু বেনিয়ম সহ্য করত না।


শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, ওই একই চাদর। গরমকালে চাদর বিছিয়ে উবু হয়ে বসে থাকত। কেউ একটা কেক কি বিস্কুট দিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেত। তারপর হাত ঝেড়ে ঝেড়ে চাদরটাকে পরিষ্কার করত। ট্রেন ঢুকলেই কড়া নজর রাখত, কেউ তার চাদর মাড়িয়ে না দেয়। শীতকালে দেখতাম সেটাকেই পা থেকে মাথা অবধি মুড়ে ঘুমোচ্ছে। দেখে মনে হত দুধপুলি। মাথা আর পায়ের দিকটা সরু, মাঝখানটা মোটা। ওই একটাই আসবাব তার জীবনে। কিংবা অলংকার। বর্ষায় চাদরটাকে টানতে টানতে রেলপুলিশের ঘরের সামনের ছাউনির নীচে টানটান করে পাতত। পুলিশকেও ভয় পেত না।


কিন্তু বুড়ো ভিখিরি, বেওয়ারিশ, পাগল। মাঝে মাঝে ওর চাদরপ্রেম দেখে বন্ধুদের সঙ্গে ইয়ার্কি করেছি এই পর্যন্তই। ট্রেনে ওঠার পর বা বাড়িতে ফিরে কোনদিন ওর কথা মনেও হয়নি।


কলেজ হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরছি বেশ রাতে। মফঃস্বলের শীত। স্টেশনের মিটমিটে হলুদ আলো আর কুয়াশা। বেশিরভাগেরই ঘরে ফেরার তাড়া। ট্রেন থেকে নেমে সামনেই দেখি রেলপুলিশের ঘরের সামনে চাদর মুড়ি দিয়ে বুড়ো শুয়ে আছে। মাথা থেকে পা অবধি মুড়ে পিঠে-পুলি হয়ে ঘুমোচ্ছে! সামনে কয়েকটা লোক। গুজগুজ করে বুড়োকে দেখছে। বুড়ো কিন্তু নিজেকে আপাদমস্তক চাদরে মুড়ে বেশ নিশ্চিন্তে চুপচাপ শুয়ে আছে।


সদ্য শেষ করা সিগারেটের গন্ধ লুকোনোর জন্যে স্টেশনে মিনিট পনেরো কাটাতে হবে। ভালোই হল, আমিও জুড়ে গেলাম ব্যাপারটা দেখতে।

ভেতর থেকে এক ভোজপুরী হাবিলদার আমাদের তাড়াতে দৌড়ে এল। "আরে ইঁহা ক্যা মেহফিল বৈঠা হ্যায়? যাও সব জাগাহ খালি করো।" লোকজন খানিক সরে গেল বটে, কিন্তু চলে গেল না। মফঃস্বল শহরে তেমন আ্যাডভেঞ্চার ঘটে কই! ভিড় একটু ফাঁকা হলে হাবিলদার কাকে যেন চিৎকার করে করে বলতে লাগল, "উসকা চাদর হাওয়া মে উড় গয়া থা। সেটা নিতে লাইনে নেমেছিল। তারপর মালগাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পোস্টে লেগে সঙ্গে সঙ্গে মরে গেছে। ঘিলু নিকলকে উধার গিরা। লেকিন সবসে বড়া বাত, ছিটকে যাবার আগেই লাইন থেকে চাদরটাকে ঠিক বুকে তুলে নিয়েছিল।"


দিন তিনেক পরে কলেজ যাবার সময় দেখি বুড়ো ভিখিরির বসার জায়গায় আট-দশটা রাধাচূড়া ফুল। ওপরের গাছ থেকেই পড়েছে। তিন চারটে চড়াই ঠিক ওই জায়গাটায় পিড়িং পিড়িং করে লাফাচ্ছে।

ওরা কি বুড়োর শ্রাদ্ধ করছে? তাই হবে, ওরা ছাড়া আর কেই বা করবে!




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন