অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২১

অন্যমনে প্রবন্ধে বারিদ বরন গুপ্ত

 


অন্যমনে প্রবন্ধে বারিদ বরন গুপ্ত
=======================




স্বার্থপর দুনিয়ার কাছাকাছি

কথায় বলে স্বার্থপর মানুষগুলো জীবনে সফল হয়, সুখের বৃত্তে বাস করে ,সত্যিই কি তাই ? তাহলে বলতে হবে আমরা স্বার্থপর দুনিয়ার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি । আজকাল মানুষ কেবল নিজের নিয়েই ভাবে, আপন খেয়ালে চলে , চাওয়া পাওয়ার বিষয়টি বর্তমানে প্রধান হয়ে উঠেছে , যতক্ষণ তোমার কাছে কিছু পাওয়ার থাকছে ততক্ষণই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার কৌশল রপ্ত করছে মানুষ ,খুব কাছাকাছি আসছে অভিনয় করে নিজের কাজ হাসিল করছে ,তারপর তোমাকে নিঃস্ব করে চলে যাচ্ছে, তুমি শুধু চেয়ে চেয়ে চেয়ে তাকাচ্ছ ,মনে করছো এটা মানুষের সমাজ না স্বার্থপর দুনিয়া নামক কয়েকটা মানুষরূপী জন্তুর সঙ্গে বসবাস করছি।



এই সেদিন এক ছাত্রের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে একজন খুবই আমার পূর্ব পরিচিত, যার সাথে একদিন সুখ-দুঃখের গল্প করেছি, অজস্র সময় অতিবাহিত করেছি ,কিন্তু দুঃখের কথা আমার কাছাকাছি থেকেও একবার ও জিজ্ঞেস করল না আমার সংবাদ, কেমন আছি ,কি করছি। মনে মনে সত্যিই হতাশ হলাম ,ভাবলাম তাহলে কি মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ গুলো হারিয়ে যাচ্ছে, সম্পর্কটা কি শুধু চাওয়া পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে ? যখন কিছু পাওয়ার থাকে ততক্ষণ সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখা, তারপর পাওনা মিটে গেলে কেটে পড়া ।এরকম সম্পর্কে বর্তমান সমাজে যেন প্রথা। হয়ে উঠেছে।



প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান নাগরিক সভ্যতার এই ছবি চতুর্দিকে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে স্বামী-স্ত্রী, ছেলে মেয়েদের সঙ্গে বাবা-মার ,আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক গুলো যেন এলোমেলো সম্পর্কের সম্পর্কের বাতাবরণ মনে হচ্ছে ,এগুলোকে বর্তমান সমাজের অসুখ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না ।আসলে প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান সমাজে মানুষ একক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাইছে, একাই দৌড়াচ্ছে, আশেপাশে কে আছে ফিরে তাকাচ্ছি না। এই ইঁদুর দৌড়ে মানুষের জীবনে নানা অসঙ্গতি ও নেমে আসছে, বাড়ছে মানসিক বিকার ইত্যাদি।



প্রাচীন যুগে যখন সমাজ এত গতিশীল ছিলনা তখন কিন্তু মানবিক সম্পর্ক গুলো এত আলগা হয়ে যায়নি, মূল্যবোধ যথেষ্ট জাগ্রত ছিল, সুখী গৃহকোণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম এক আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকতো, সুখ দুঃখের ভাগিদার হিসেবে জীবন অতিবাহিত করতে, মানুষ একে অপরের বিপদে আপদে ঝাপিয়ে পড়তো ,এটাকে তাদের কর্তব্য হিসেবে মনে করত , কিন্তু এখন অতীত, এই নৈতিক কর্তব্য কিভাবে হারিয়ে গেল এই প্রশ্নটাই এখন ঘোরাঘুরি করছে।



প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে ভারতীয় সমাজ ছিল অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই সমাজে পরিবারের গুলি ছিল যৌথ। এই যৌথ পরিবারে সকল সদস্যই যৌথ সম্পত্তির মালিক ছিল ।সকলে একসাথে থাকা খাওয়া, জীবন-জীবিকা অতিবাহিত করার জন্য সমাজের সব সময় একটা সংহতি বিরাজ করতো। যৌথ পরিবার ছিল সুখী গৃহকোণ, যার জন্য সমাজ ব্যবস্থাকে আরো সংহতি এনে দিয়েছিল এবং তাদের মধ্যে এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তৎকালীন সমাজে। বলতে গেলে এই সম্পর্কটাই সমাজকে একটা সংহতি দান করেছিল, যার জন্য তৎকালীন সমাজ যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল বলা যায়।



পরবর্তীকালে শিল্পায়ন ও নগরায়ন এবং পাশ্চাত্যকরণের প্রভাবে যৌথ পরিবার গুলি ভেঙে টুকরো টুকরো নিউক্লিয়ার পরিবার তৈরি করে, তখন থেকেই শুরু হয় একক সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগ ।সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ, এর পর সমাজ যত গতিশীল হয়েছে ততই সমাজ থেকে মানবিক সম্পর্ক গুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং দ্রুত সমাজ থেকে মূল্যবোধগুলো হঠতে থাকে, সমাজে বাড়তে থাকে বিভিন্ন দুর্নীতি,একে অপরকে বঞ্চিত করে নিজের আখের গোছাতে সদা ব্যস্ত থাকে মানুষ। যার ফলে সমাজ থেকে দ্রুত মূল্যবোধ হঠতে থাকে। শুরু হয় অবক্ষয়।



বর্তমানে সমাজ থেকে যেভাবে নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে ,চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক গড়ে উঠছে, চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যাচ্ছে, যাকে সমাজতাত্ত্বিকগন সমাজের অসুখ হিসেবে বিবেচনা করছেন। এই অসুখ যদি অদূর ভবিষ্যতে মহামারীর আকার নেয় তাহলে তার চিত্রটা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয় ।এই অবস্থায় বর্তমান সমাজে মূল্যবোধের জাগ্রত করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। কারণ মূল্যবোধ যত জাগ্রত হবে ততই সমাজ শক্তিশালী হবে সমাজের সংকট দূর হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন