অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২১

অন্যমনে অণুগল্পগুচ্ছে সুতপা দাস

 
অন্যমনে অণুগল্পগুচ্ছে সুতপা দাস
========================



জঠর-জাত র জন্য


গুঙিয়ে উঠলো সুভাগা । তলপেট টা যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। পাথরের মতো চাপ টা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি গুলো সব যেন একসাথে দলা পাকিয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত চিপে চোখ বন্ধ করে ব্যথা টা সহ্য করতে চেষ্টা করছে সুভাগা।
ডাক্তার এখনও এসে পৌঁছায়নি। গ্রাম্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলো এভাবেই ধুঁকছে উপযুক্ত পরিসেবা র অভাবে।
ওঃ মাগো আর পারছি না - আবার ও গুঙিয়ে উঠলো সুভাগা। দশ মাসের ভরা পোয়াতি সে। এই প্রচন্ড যন্ত্রণাকে ভুলে থাকতে অতীত হাতড়াতে লাগলো ও ।ওর জন্মের পর পরই বাবা ব্যবসায় খুব লাভ করেছিল, তায় সৌভাগ্যের প্রতীক স্বরূপ আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিল সুভাগা ।বাবা বলত মেয়ে সন্তান বাড়ির লক্ষ্মী হয়।বাবার বাড়িতে বেশ আদরেই বেড়েছে সে। এরপর বিয়ে হয়েছে, অনেক দূরের গ্রামের বাবার‌ ই পরিচিত এক গৃহস্থ বাড়িতে। শ্বশুর বাড়িতে বড় পরিবার, অনেক লোকজন, অনায়াসে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়েছিল সুভাগা কিন্তু সময়মতো সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি সে। কপালে জুটেছে 'বাঁঝা বৌ' এর তকমা। এরপর ডাক্তার -কবিরাজ- বদ্যি -মাদুলি -কবজ- মানত কত কী করতে করতেই কেটে গেছে দশটা বছর। অবশেষে গর্ভসঞ্চার হয়েছে তার।বহু প্রতিকুলতার মাঝে নয়টা মাস কাটিয়ে এসে আজ সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে সে। মেয়ে থেকে বউ, বউ থেকে মা হওয়ার পথে কেটে গেছে এগারো টা বছর। আর মাত্র কিছুক্ষণ এর অপেক্ষা। সময় যেন থেমে গেছে। ধীরে ধীরে আবার ব্যথা টা চাগিয়ে উঠল। মুচড়ে উঠছে শরীরটা, অবস হয়ে আসছে হাত পা মাথা। আর কতক্ষন ... জল থেকে সদ্য ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত ছটফট করে উঠলো সুভাগা।
কখন থেকে ও.টি র পোশাক পরিয়ে নার্সও ডাক্তার এর অপেক্ষায়। ডাক্তার বাবু কে ফোন করার পর কেটে গেছে তিন তিনটা ঘন্টা। রোগীনির অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে উঠতে দেখে নার্স ও চিন্তিত হয়ে পড়ে। অবশেষে কে যেন বললো ডাক্তার বাবু চলে এসেছে। ডাক্তার বাবু হাত-পা ধুয়ে পোশাক পরতে সময় নিল আরও আধঘন্টা। সুভাগার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে উঠলো। নর্মাল ডেলিভারি সম্ভব ছিল না তাই সুভাগাকে ও .টি তে নেওয়া হলো সিজার এর জন্য। শুরু হলো অপারেশন।একটু পরেই সুভাগার কানে আসলো উঁ আ ধ্বনি। জ্ঞান হারালো সুভাগা , আর ফিরল না।

মেহুল ও মেহুল ...কখন থেকে ডাকছি তোকে , এবার খেয়ে নে রাত তো অনেক হলো। মায়ের ডাকে হুঁশ ফিরল মেহুলের। আজ বিকেলে বন্ধুদের সাথে 'নাট্যমহল' এ অখ্যাত এক নাট্যদল কর্তৃক মঞ্চস্থ "সুভাগার উপাখ্যান" নামে একটি নাটক দেখতে গেছিল মেহুল। নাটকের বিষয় টা নাড়া দিয়ে গেছে ওর মনে। বেচারী সুভাগা! মা ডাকটা শোনার জন্য কত কষ্ট সহ্য করল কিন্তু তা আর শোনা হল না ওর , শুধু জানল তার আত্মজ পৃথিবীর আলো দেখেছে।সুভাগা তো শুধুই একটা নাট্য চরিত্র না, এইরকম কত সুভাগা আমাদের চারপাশে অকালে ঝরে যাচ্ছে শুধুমাত্র কিছু মানুষের অবহেলায়। একটি সন্তান এর জন্ম দিতে কত কষ্ট সহ্য করে একটা মা। হঠাৎ ই মেহুলের মন টা হু হু করে উঠলো ওর মায়ের জন্য।দৌড়ে গেল খাবার টেবিলে , মেহুল কোন কথা বলতে পারল না মাকে । শুধু ওর চোখ বেয়ে নেমে এলো দুফোঁটা জল। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।



নাম না জানা লেখাটা


পরিবর্তন ই জীবন জানি কিন্তু এত দ্রুত বদলে যেয় না। আমাকে সামলানোর জন্য একটু সময় দাও। আমি পারবো নিশ্চয়ই পারব ..….…" নাম না জানা কোন একজনের লেখার এই অংশটা মেহুলের মনে দাগ কেটে আছে।

পাড়া‌র দোকানে বাজার করা জিনিসগুলোর কোনো একটা ঠোঙার কাগজে ছিল এটা। কাগজগুলো গুছিয়ে ফেলতে গিয়ে হঠাৎ ই চোখ আটকে ছিল লেখাটায়। বহু পুরনো এক সংবাদ পত্রের গল্পের ছেঁড়া পাতা ওটা।

আচ্ছা কথাগুলো কি কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলেছিল নাকি প্রেমিকা তার প্রেমিককে ; কোন স্বামী তার স্ত্রীকে নাকি স্ত্রী তার স্বামীকে; নাকি সময়- পরিস্থিতি - জীবন এইসবের সাথে যুঝতে থাকা কোন অসহায় মানুষ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে হার না মানার প্রবোধ বাক্য শুনিয়েছে .. কোনটা ! নাকি আরও অন্য কিছু ! উত্তরহীন প্রশ্ন শুধুই।


মেহুল ও তো সময় কে বলেছিল এই একইরকম কথা। ছোট্টবেলায় বাবাকে হারিয়ে মা এর হাত ধরে বেড়ে উঠতে উঠতে মেহুল দ্রুত সামলে উঠছিল বাবাকে হারানোর দুঃখ। মেহুল পেরেছিল। খবরের কাগজের গল্পের চরিত্র টা কি পেরেছিল ? ভাবনাটা কিছুতেই পিছু ছাড়ে না ওর।


একদিন হঠাৎ করেই ওর হাতে আসে পত্রিকাটা। রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলে মেহুল। কষ্ট পাকিয়ে ওঠে ওর গলার কাছে । গল্পের অসহায় স্বামীটি তার সদ্য চাকরি পাওয়া স্ত্রীকে অনুনয় করছে তাকে ছেড়ে না যেতে। স্ত্রীর চাকরির জন্য আঠেরো লাখ টাকা জোগাড় করতে বাড়ির সাথে সাথে একটা কিডনি ও গোপনে বিক্রি করেছিল সে । মোটা মাইনের সরকারি চাকরি পেতেই স্বল্পশিক্ষিত স্বামীর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে স্ত্রী । তার স্ট্যাটাস জেগে উঠেছে । সাধারন খেটে খাওয়া স্বামীর পরিচয় দিতে সম্মানহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তার। তবুও নিঃস্বার্থ ভালোবাসে পাশে থাকতে চেয়েছে স্বামী। তার‌ই কাতরতা উঠে এসেছিল ছেঁড়া পাতায়।



তাদের কথা


আলপথ ধরে হেঁটে চলা মেয়েটি কখন যেন পৌঁছে যায় সেই ধানক্ষেতটি তে , কদিন আগেই যেখান থেকে কেটে তোলা হয়েছে অগ্রহায়ণ এর ফসল। সেই সোনালী ফসল কে ঘিরে গ্রামবাংলা র ঘরে ঘরে পালিত হয়েছে নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের গন্ধে ব্যাকুল হয়ে মা লক্ষ্মী এসেছেন গৃহস্থের ঘরে, সন্তুষ্ট হয়ে দিয়েছেন ধনের বর।

সে ধন ধরে রাখতে পারেনি বীরু, বীরেন্দ্র বাগুই। মেদিনীপুর এর প্রত্যন্ত গ্রাম বাধিয়া র একপ্রান্তে ওদের ক-ঘর বাগুই এর বাস।ওড়িশার গা ঘেঁষে।


জমির ধান বস্তা ভরে মন্ডিতে নিয়ে যেত বীরু। ভালো দাম পেলে সাধারণ ক্রেতাকে ধান বেচত নয়তো সরকার পক্ষকে বেচে আসত নূন্যতম সহায়ক মূল্যে। যা পেত তাতে মহাজনকে সুদ দিয়েও বেশ কিছু নগদ হাতে থাকতো। কিন্তু এবারে কিছুই লাভ হলো না। সরকার থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা টা উঠে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ফোরে দের কাছে ফসল বেচেছে গ্রামের সকলে, ফোরেদের ই ঠিক করা দামে। সব টাকা মহাজনের ধার শুধতেই চলে গেল। সম্বৎসর নিজেদের ছোট খাটো প্রয়োজন মেটানোর মতো ও কিছু বাঁচেনি


সেফটিপিন আঁটকানো ছেঁড়া চটি পড়ে সুলতি হেঁটে চলে আলপথ ধরে। সদ্য কাটা ধানের গন্ধ শোঁকে। যে ধান তার জন্য একজোড়া চটি কিনতে পারত আর মায়ের পরনের কাপড়।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন